উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮/১২/২০২৪ ১০:১৫ এএম

বান্দরবান পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় জমি কেনাবেচার আগে খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, জমির পরিমাণ ও মৌজার বিষয়ে সার্ভেয়ারকে সরেজমিনে তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দিতে হয়। ওই প্রতিবেদন দেওয়ার আগে জমি কেনাবেচা করা যায় না। এ অবস্থায় জমির মালিকরা ওই প্রতিবেদনের জন্য সদর উপজেলা ভূ‌মি অফি‌সে এলে আগেই মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করেন সদ‌র উপজেলা ভূ‌মি অফি‌সের সার্ভেয়ার মো. ইব্রা‌হিম ফয়সাল‌।

ঘুষ না দিলে মাসের পর মাস প্রতিবেদনের জন্য তাদের ঘোরানো হয়। অনেক সময় দেখা যায়, ঝামেলাযুক্ত জমিগুলোর ক্ষেত্রে একজনের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঘুষ নিয়ে ওই জমি আরেকজনের উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিয়ে দিচ্ছেন। ফলে প্রকৃত মালিক জমিটি হারাচ্ছেন।

খোঁজ নি‌য়ে জানা‌ গে‌ছে, বান্দরবানে আসার আগে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি হুকুম দখল কার্যালয় (এলএ) শাখার সার্ভেয়ার ছিলেন ইব্রা‌হিম ফয়সা‌ল। ২০২২ সালে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঘুষের ২৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯০০ টাকাসহ গ্রেপ্তার হন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার সার্ভেয়ার আতিকুর রহমান। ওইদিন তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন কক্সবাজারের আদালত।

রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে কক্সবাজারের ১২ জন সার্ভেয়ারের নাম বলেন। তখন কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা, রাজস্ব শাখা ও উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত ১২ জন সার্ভেয়ারকে একযোগে বদলি করা হয়। এদের একজন ইব্রা‌হিম ফয়সাল। যা‌কে দুর্নী‌তির দা‌য়ে বান্দরবা‌নে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছিল।

বান্দরবান জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে আসার পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন সার্ভেয়ার ফয়সাল। ভূমি অধিগ্রহণ করতে আসা জমির মালিকদের কাছ থেকে ঘুষ লেনদেনে জড়িয়ে পড়েন। ঘুষ ছাড়া ভূমির কোনো কাগজপত্র দিচ্ছেন না। এমনকি খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, জমির পরিমাণ ও মৌজা ঠিক থাকা সত্ত্বেও মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে প্রতিবেদন দিচ্ছেন। আবার যার কাছ থে‌কে বে‌শি টাকা পা‌চ্ছেন, তার পক্ষে জমির প্রতিবেদন দিচ্ছেন। ঘুষ না পেলে ঘটে বিপত্তি।

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, কয়েক মাস আগে সুয়ালক ইউনিয়নে বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের পা‌শে বন বিভা‌গের জায়গার বিপক্ষে মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরি করে জায়গাটি সা‌বেক জেলা প্রশাসক কার্যাল‌য়ের না‌জির আইয়ুবের নামে হস্তান্তর ক‌রে‌ছেন সার্ভেয়ার। পরে আইয়ুব বন বিভা‌গের জায়গাটি দখ‌লে নেন। সম্প্রতি সেই জমি বি‌ক্রি ক‌রে দুজ‌নেই পাঁচ কো‌টি টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। বিষয়টি স্বীকার করেছেন আইয়ুব।

এক থেকে দুই লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে প্রতিবেদন নিয়েছেন এমন পাঁচ জন ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, ভূ‌মি অফি‌সের সার্ভেয়ারের সরেজমিনে তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া এখানের কোনো জমি বেচাকেনা করা যায় না। এই সুযোগ নিচ্ছেন সার্ভেয়ার। খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, জমির পরিমাণ ও মৌজা ঠিক থাকা সত্ত্বেও জমির পরিমাণ বুঝে এক থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ চান। টাকা না দিলে এক বছরেও প্রতিবেদন দেন না সার্ভেয়ার। শেষমেশ বাধ্য হয়ে সবাই ঘুষ দিচ্ছেন। আবার কেউ এসব নিয়ে কথা বললে কিংবা প্রতিবাদ জানালে তাকে হয়রা‌নির শিকার হতে হয়। জমিও হারাতে হয়। এসব নিয়ে বান্দরবানের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ফয়সল উদ্দিনের কাছে অভি‌যোগ করেও কোনো সমাধান মেলেনি।

কেন সমাধান মেলেনি জানতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ফয়সল উদ্দিনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি।

নিজের জমি বিক্রি করার জন্য সার্ভেয়ারের কাছে সরেজমিনে তদন্ত প্রতিবেদন চেয়ে ঘুষ দিতে অস্বীকার করায় জমি হারিয়েছেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মো. সোলায়মান। তিনি বলেন, ‘আমার খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, জমির পরিমাণ ও মৌজায় কোনো ভুল ছিল না। কেনা জমিটির সব কাগজপত্র সঠিক থাকার পরও আরেকজন‌কে আমার জায়গার প্রতিবেদন দিয়ে দখল দিয়েছেন সার্ভেয়ার ফয়সাল। পরে আমি বিষয়‌টি সদরের ইউএনওকে জা‌নি‌য়ে‌ছি। তি‌নি ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দি‌য়ে‌ছেন। পরে স‌ঠিক প্রতিবেদন দেবেন ব‌লে আশ্বস্ত করলেও গত ছয় মাসেও দেওয়া হয়নি।’

‘এমন অভিযোগ অনেকে করে। এগুলো আমি গুরুত্ব দিই না। আর এসব নি‌য়ে রি‌পোর্ট কর‌লে আমার কিছুই হ‌বে না। এর চে‌য়ে বড় বড় মামলায় আমার কিছুই হয়‌নি। আমা‌র এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবগত আছেন। তাদের জানান।’

একইভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন জেলা সদরের বাসিন্দা মোহাম্মদ রফিক। তিনি বলেন, ‘আমার জায়গার শুনা‌নিতে আমা‌কে ছাড়াই ক্রেতা‌কে প্রতিবেদন দেওয়ায় পাঁচ লাখ টাকার জ‌মিটি হারাতে হ‌য়ে‌ছে। এমন দুর্নীতিবাজ সা‌র্ভেয়ার জীবনেও দেখিনি। এসিল্যান্ড কিংবা জেলা প্রশাসককে জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি।’

সদরের বাসিন্দা মো. তৌ‌হিদ পার‌ভেজ বলেন, ‘সার্ভেয়ার ফয়সালের চাহিদামতো ঘুষ না দিলে বলা হয়, জমির কাগজপ‌ত্রে নানা সমস্যা। এসব ঠিক করতে টাকা লাগবে। টাকা দিলে সব ঠিক। না হয় মাসের পর মাস হয়রা‌নি ক‌রেন। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে জেলার সব গ্রাহককে হয়রানি করে ঘুষ নিচ্ছেন ফয়সাল।’

আমার একটা জমির ফাইল ৯ মাস ধ‌রে সার্ভেয়ার ফয়সালের কা‌ছে প‌ড়ে আছে বলে জানালেন সদরের বাসিন্দা জয়নাব বেগম। তিনি বলেন, ‘এখনও রিপোর্ট দেয় নাই। এসিল্যান্ড বলার পরও নানা কথা বলে ঘোরাচ্ছেন সার্ভেয়ার। শেষে আমার কাছে এক লাখ টাকা চেয়েছেন। দি‌তে পা‌রি‌ নাই। তাই আজও রিপোর্ট দেয়নি। জমির কাগজপত্র সব ঠিক থাকার পরও রি‌পোর্ট দেয় না। টাকা ছাড়া দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমি এত টাকা পাবো কোথায়? এত টাকা আমার কাছে থাকলে কি আর জমি বিক্রি করতে চাইতাম।’

অবশ্য সাধারণ মানুষের এসব ভোগান্তিকে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না ইব্রা‌হিম ফয়সাল‌। জমির প্রতিবেদন নিতে আসা মানুষের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইব্রা‌হিম ফয়সাল বলেন, ‘এমন অভিযোগ অনেকে করে। এগুলো আমি গুরুত্ব দিই না। আর এসব নি‌য়ে রি‌পোর্ট কর‌লে আমার কিছুই হ‌বে না। এর চে‌য়ে বড় বড় মামলায় আমার কিছুই হয়‌নি। আমা‌র এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবগত আছেন। তাদের জানান।’

একজন সা‌র্ভেয়ারের এমন দাম্ভিকতার স্বরে কথা বলা ও ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে অনেকটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ‌শাহ মোজাহিদ উদ্দিন। তিনি ব‌লেন, ‘সার্ভেয়ার ইব্রাহিম ফয়সালের বিরুদ্ধে আমার কা‌ছে কিছু অভিযোগ আগেও এসে‌ছিল। এখনও আসছে। তার নানা অনিয়‌মের খবর শুন‌লেও আমার কিছুই করার নেই। যে‌হেতু সার্ভেয়ারদের বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনার সরাস‌রি দেখভাল ক‌রেন, তাই বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনারকে জানা‌নো ছাড়া কোনো উপায় নেই।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. জিয়াউদ্দীন ব‌লেন, ‘সা‌র্ভেয়ার ইব্রা‌হিম ফয়সালের ঘুষ নেওয়া ও মানুষ‌কে হয়রা‌নির বিষয়টি আমি এখন জানলাম। এ নিয়ে কেউ আমার কা‌ছে লি‌খিত অভি‌যোগ দেননি। ত‌বে সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত অভি‌যোগ পে‌লে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

পাঠকের মতামত

সড়ক থেকে রোহিঙ্গা প্রতিরোধে তৎপর নেই হাইওয়ে পুলিশ রোহিঙ্গা চালকের নিয়ন্ত্রণে উখিয়ার বিভিন্ন সড়ক!

ফিটনেস বিহীন গাড়ি ও অদক্ষ রোহিঙ্গা চালকের দৌরাত্ম্য বেড়েছে উখিয়ায়। তার মধ্যে বেশিরভাগই ১৮ বছরের ...

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হেপাটাইটিস-সি প্রতিরোধে ১০ লাখ ইউরো দেবে ইইউ

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হেপাটাইটিস-সি এর আশঙ্কাজনক বিস্তাররোধে ১০ লাখ ইউরো মানবিক সহায়তা ঘোষণা করেছে ইউরোপীয় ...